Site icon Anirban Saha

প্রধানত হার্জ

কলকাতার থেকে একটু দূরেই যেমন দার্জিলিং, সিক্কিম, বা পুরুলিয়া’র জয়চণ্ডী পাহাড়, তেমনি মাগডেবর্গের একটু দূরেই আছে হার্জ । হিমালয় নয় অবশ্যই, কিন্তু এক দিন স্ট্রেসের থেকে ব্রেক নেওয়ার জন্য যথেষ্ট! হার্জ পাহাড়, প্রায় দু-ঘণ্টা দুরত্তে – সকালে গিয়ে বিকেলে ফেরৎ আসা যায়। 

মাগডেবর্গ বেশ মজাদার জায়েগায় উপস্থিত। কাছেই ৩ টে আধুনিক বড় শহর, ছোট ছোট মধ্যযুগীয় কয়েকটা শহর, একটু পাহাড়, অনেকটা ঘন বন আর পর্যটকদের জন্য সুনিপুণ ভাবে প্রধানত জার্মান ভাসাতেই সব তথ্য লেখা আছে। মানে, আমাদের মতন লোকেদের হয়ত জার্মান ভালো ভাবে শিখতে হবে, নইলে অনুবাদ করার জন্য বন্ধুকে নিয়ে যেতে হবে। আর দরকার এক দুজন পাগল বন্ধু, যারা এক কথায়ে এক পায়ে খাঁরা হয়ে যাবে যাওয়ার জন্য। দুটোর একটাও কঠিন নয় পাওয়া।  

একটু কিছুক্ষণের প্লানিং, আর কিছুক্ষনের রান্না ব্যাস। পরের সকাল ৫ টায় বেরিয়ে পড়লাম। ৫ টা চল্লিশের ট্রেন। ট্রেন মাগডেবর্গ থেকে যাবে হাল্ব-স্টাড। হাল্ব-স্টাড থেকে ওয়েরনিগেরদা। ওখান থেকে শীওড়কা। ওখান থেকে ট্রেক শুরু। প্রায় ৬ কিলোমিটার হাটা, ৫০০ মিটার উচ্চতায়। 

ভদ্রমহিলারা এইদিন ডাইনি সেজে আসেন। ডাইনির রাত!

মজার প্রশঙ্গে বলি, এই হার্জ পাহাড়েই অনেক গল্প আছে, গল্প জার্মান ডাইনি বুড়িদের। এখন প্রতিবছর “ডাইনিদের রাত” এখনও বেশ ভালো ভাবেই পালন করা হয়। আর খুব ভুল বলা হবে না যদি আমি বলি যে, বিদেশি ডাইনি, তার অশুভ হাসি, কালো জামা, মাথার পয়েন্ট টুপি, ঝাঁটার উপরে বসে ঊরে যাওয়া – এই জনপ্রিয় ডাইনির কল্পনা কিন্তু প্রধানত এই হার্জের গল্পের থেকে আমরা পাই।  টু বি স্পেসিফিক, ব্রখেন পাহাড়ের ডাইনির গল্পের থেকে। 

মরা গাছ। সেই বনের মধ্যে দিয়ে হেটে ওঠা। ছবি তুলেছে কার্ল। কার্ল স্টারমান-লয়কা।

আমরা এইবারের বার কিন্তু শীওড়কা থেকে হেটে হেটে এই, ব্রখেন পাহাড়েই উঠবো। হার্জ পর্বতশ্রেণির সব থেকে উঁচু পাহাড়, ব্রখেন। উচ্চতায় আমাদের দার্জিলিঙের অর্ধেকের থেকে একটু বেশী। দুবার যখন দার্জিলিং দার্জিলিং করেই ফেললাম, এটাও বলা জরুরি যে ওয়েরনিগেরদার থেকে  ব্রখেন পাহাড়ে যাওয়ার জন্য ধুওা ওড়ানো কু-ঝিক ঝিক স্টিম ইঞ্জিন ট্রেন আছে। বেশ মজা না? 

সকালের প্রথম আলো। ছবিঃ মধু কিরণ রেড্ডি ঠাটিকন্ডা।
হাল্ব-স্টাডে সকাল বেলা। ছবিঃ অঙ্কিত মুখার্জি।
স্টিম ইঞ্জিন । ছবিঃ অঙ্কিত মুখার্জি।

সকালের সূর্য ওঠার থেকে শুরু করে স্টিম ইঞ্জিন, বার বার দুই জনের সিগারেট-কফি ব্রেক নেওয়া আর আমার জার্মান বন্ধুর ধুয়ার থেকে পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা – শুরু টা বেশ ভালোই কাটল। তার পর শুরু হল হাটা। এই হাটার সময়টা একটু জবর করার জন্য পুর রাস্তাটা ৬ ভাগে ভাগ করে, এক একটা ভাগে একটা গল্পের একটা ভাগ লিখে রাখা হয়েছে। মানে – গল্পের একটু পড়তে হবে, তার পরে হাঁটতে হবে। না হাঁটলে, গল্পের পরের ভাগ আর পাবে না। এই করতে করতে ৫ ভাগ ওই মরা বনের মধ্যে হেটে শেষ করে ফেললাম। কী করে যে আমি শেষ করলাম সে এক আমি-ই জানি। অনেক দিন লাফা লাফি করিনি। হাটা হাটিও ঠিক করিনি প্রায় দু-বছর। আর এই দু বছরে বাড়িয়েছি প্রায় ১৮ কিলো ওজন। আর চারটে বাচ্ছার সাথে পেরে ওঠা যায়? 

বন। ছবি তুলেছে মধু কিরণ রেড্ডি ঠাটিকন্ডা ।
সেই বন। ছবি তুলেছে অঙ্কিত মুখার্জি।
ইন্দ্রনীল, আমি, মধু, অঙ্কিত, কার্ল।

যেই মাত্র নিজেকে বুড় ভেবে সহানুভূতি পাওয়ার লোভে বেশ আর চারজনকে দার করালাম, দেখি আমার দাদু-দিদার বয়সী এক দাদু আর এক দিদা, হাত ধরা ধরি করে, ট্রেক করছে। সঙ্গে ছোট্ট কুকুর। হাটতে পারে না, তাই দাদুর কোলে একদিক ওদিক তাকিয়ে পাহাড় আর বন দেখছে। আর একটু  হাটতেই দেখি কত দাদু সাইকেলে করে পাহাড়ে উঠছে। অঙ্কিত পাস দিয়ে যাবার সময় কানের পাসে এসে বলল, “তুমি এদের থেকেও বুড়?” কী আর করি? 

পাহাড় আর বনে যাওয়ার কিন্তু প্রধান কারণ ছিল পাখি দেখা আর পাখির ছবি তোলা। কার্ল, আমার জার্মান বন্ধু, ঠিক সেটা বুঝে উটতে পারেনি সারাদিন। দুটো বাঙালি, একটা কার্ল আর মধু। মধু খুব ভালো, ও কোন কথাই বলে না। ফেরার পথে কার্ল, অঙ্কিত আর আমি বেশ গান গাইতে গাইতে পাহাড় থেকে নামলাম। আরে, পাহাড়ে ওঠার কথাই তো এখনও শেষ হয়েনি! 

বাচ্চা বয়সে আমার মা আমাকে মাটিতে চোখ রেখে হাটতে শিখিয়েছিল। উদ্দেশ্য – যাতে আমি গু না পাড়াই। পাড়াইনি। ছোট বেলাতেও না, ৩০ বছরেও না। কিন্তু অভ্যাসটা থেকে গেছে। পাখি উপরে থাকে, আর আমার চোখ নিচের দিকে। আমি হাটি নইলে পাখি দেখি। দুটো এক সাথে হয়না। আর চারজন যে ভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল, দা চয়েস ওয়াস ক্লিয়ার। পাখি আমি বেশি নিজে দেখতে না পেলেও, চুপ করে থাকা মধু একটা পাখি দেখতে পায়ে। অনেক দূরে একটা মরা গাছের ডালে একটা ইউরেশিয়ান যে। ইন্দ্রনীল কয়েকটা পাখি দেখেছে। 

ইউরেশিয়ান যে । ছবি আমি তুলেছি!
ইউরোপিয়ান রবিন । ছবি আমি তুলেছি।

পথের শেষের দিকে, প্রায়ে তখন আমরা পাহাড়ের মাথায়। দেখি, ক্রমশ আমরা মেঘের ভেতরে হেটে যাচ্ছি। থামবার জো নেই, সবাই এগিয়ে যাচ্ছে! সব শেষে পৌছালাম  ব্রখেনের উপরে। প্রচণ্ড কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া, মাঝে একটু রোদ। যতদূর চোখ যায়, ততদুর খালি কুয়াশা। “আ লিটিল দ্যাট সাইড ইস ওয়েরনিগেরদা”। আমি মাথা নাড়লাম। কার্ল আর একটু ঘুরে আঙ্গুল তুলে বলল, “অ্যান্ড আ লিটিল দ্যাট সাইড ইস মাগডেবর্গ”। হ্যা, মানে আরকি … একদম! “ইফ দা স্কাই ওয়াস ক্লিয়ার, ইউ কুড হ্যাভ সীন দা দোম”। “একদম দাদা, ঠিক বলেছেন”। 

উপর থেকে উপত্যকা। ছবি তুলেছে কার্ল।
ইগ্নোর দা এক্সপ্রেস্নস প্লিস। ব্রখেন ১১৪২ ম ।

একদিকে উপত্যকা যেখান থেকে সব শহর দেখা যায়। অন্য দিকে আর ঘন বন। ওইদিকের বনে অনেক পশু ও পাখি দেখতে পাওয়া যায় শুনেছি। আর মাঝের জায়েগা খুব সুন্দর করে সাজানো। এক ফলকে লেখা “ব্রখেন ১১৪২ ম”। 

Exit mobile version